সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০১:৩৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সামুদ্রিক কাছিমের মৃত্যুর মিছিল

মীর মোহাম্মাদ আলী:
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমরা পেয়েছি সামুদ্রিক জীব-বৈচিত্র্যের স্বর্গরাজ্য বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর, বঙ্গোপসাগরে রয়েছে জলজ জীব-বৈচিত্র্যের এক অনন্য সম্ভার। সামুদ্রিক মাছ, তিমি, কাছিম, হাঙ্গর, পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাস এই সাগরে। বাংলাদেশের জলসীমায় ৫ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম বিচরণ করে। এরা হচ্ছে অলিভ রিডলে কাছিম, সবুজ কাছিম, হকসবিল কাছিম, লেদার ব্যাক কাছিম ও লগার হেড কাছিম। সুন্দরবন থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত প্রধানত অলিভ রিডলে ডিম পাড়ে এবং সবুজ কাছিম গুটিকয়েক জায়গায় দেখা যায়। দেশের মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপই একমাত্র জায়গা যেখানে হকসবিল কাছিম ডিম পাড়তে আসে। কিন্তু মানবসৃষ্ট হুমকির কারণেই কাছিমের সংখ্যা আজ সংকটাপন্ন।

সারা পৃথিবীতে সাধারণত দেখতে পাওয়া সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিমের মধ্যে সবচেয়ে ছোট প্রজাতি অলিভ রিডলি, যার বৈজ্ঞানিক নাম Lepidochelys olivacea। সাগরে এরা প্রায় ৫০ বছর বাঁচে এবং দুই থেকে আড়াই ফুট দৈর্ঘ্যরে এসব কাছিমের ওজন হয় সর্বোচ্চ ৫০ কেজি পর্যন্ত। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর লাল তালিকায় সংকটাপন্ন (Vulnerable) হিসেবে চিহ্নিত এই প্রজাতি সাধারণত উষ্ণ মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে দেখা যায়। এরা জন্মের পর থেকে সারা জীবন উন্মুক্ত সাগরেই থাকে। কিন্তু ডিম পাড়ার সময় দল বেঁধে হাজারে হাজারে অলিভ রিডলি মা কাছিম ছুটে যায় জন্ম উপকূলের দিকে। পুরুষ কাছিমরা জন্মের পর মুক্তভাবে সাগরে বিচরণ করে এবং কখনো আর সৈকতে ফিরে আসে না। সৈকতের বালিয়াড়ির বাসা থেকে ডিম ফুটে বের হওয়ার পর দল বেঁধে সাগরে ফিরে যায় অলিভ রিডলির বাচ্চারা। প্রায় ১৯ বছর সাগরে বিচরণ শেষে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, স্ত্রী কাছিমরা ডিম পাড়ার জন্য তখন জন্মভূমিতে ফিরে যায়। কিন্তু দীর্ঘ ১৯ বছর পর স্ত্রী অলিভ রিডলি কীভাবে মাতৃভূমি খুঁজে বের করে, তা আজও এক বিস্ময়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত নানা প্রতিকূলতা থেকে ডিম রক্ষার জন্যই দল বেঁধে জন্মস্থানে ফিরে বাসা করে ডিম ছাড়ে মা কাছিম।

সেন্টমার্টিন থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ৭১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ডিম পাড়ে মা কাছিম। এরমধ্যে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, প্যাঁচার দ্বীপ, হিমছড়ি, উখিয়া সোনারপাড়া, ইনানি সৈকত ও সোনাদিয়া দ্বীপে বেশি ডিম দেয়। ডিম দিতে এসে এসব কাছিম ১৫-১৯ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পথ পাড়ি দেয় এবং ডিম দেওয়ার জন্য সৈকতে শতভাগ বালি আছে এমন স্থানই বেছে নেয়, কাদা বা ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে ডিম দেয় না অলিভ রিডলি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত বিভিন্ন অপরিকল্পিত কার্যক্রমে ডিম দেওয়ার পরিবেশ ও উপযুক্ত স্থান নষ্ট হওয়ায় আমাদের সৈকত দিনে দিনে অলিভ রিডলির জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এতদিন সৈকতের বালিয়াড়ি ছিল অনিরাপদ কিন্তু এখন সাগরের মুক্ত পরিবেশও তাদের জন্য মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন অলিভ রিডলি আমাদের উপকূলে আর পাওয়া যাবে না, যা হবে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।

অলিভ রিডলির ডিম পাড়তে শব্দহীন ও অন্ধকার সৈকত প্রয়োজন। দিনে দিনে আমাদের মহেশখালী ও মাতারবাড়ী উপকূলে বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠছে, যার ফলে সৈকতের এই অংশে ডিম দিতে আসা মানেই হচ্ছে তাদের নিশ্চিত মৃত্যু। কক্সবাজারের বিভিন্ন সৈকতে দুই মাসে প্রায় ৯৫টি মৃত অলিভ রিডলি প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম ভেসে এসেছে। অথচ, কক্সবাজারের স্থানীয়দের মতে ২০১০ সালের দিকে সৈকতে যখন মানুষের কার্যক্রম কম ছিল, তখনো ৩০-৪০টি করে কাছিম দল বেঁধে সৈকতে আসত। আর ডিম ফোটার পর হাজারখানেক ছোট কাছিম ফিরে যেত সাগরে।

বাংলাদেশে প্রায় আড়াইশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার আছে, যেগুলো উপকূল থেকে শুরু করে দূরবর্তী সমুদ্র অঞ্চল পর্যন্ত ট্রল নেট (বড় টানা জাল) ব্যবহার করে মাছ ধরে। এসব মাছ ধরার ট্রলার বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ৪০ থেকে ৭০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত চষে বেড়ায়। এছাড়াও উপকূলের কাছাকাছি থেকে মাছ ধরে প্রায় ৬৫ হাজারেরও বেশি ট্রলার, যারা গিল নেট বা ভাসমান ফাঁসজাল ব্যবহার করে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সাধারণত অলিভ রিডলির ডিম পাড়ার সময়, যখন সাগরে লবণাক্ততা বেশি, পলির পরিমাণ কম ও পানি অপেক্ষাকৃত বেশি স্বচ্ছ থাকে। এছাড়াও সাগর তুলনামূলক কম উত্তাল থাকায় কাছিমের উপকূলের দিকে আসাটা সহজ হয়। সুতরাং উপকূলের দিকে ডিম দিতে আসা বা গভীর সমুদ্রে থাকা উভয় সময়েই কাছিম জালে আটকে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং পরবর্তী সময়ে মারা যায়।

সাগরে অতিরিক্ত ট্রলিং (লম্বা আকারের ছোট ফাঁসের টানা জাল টেনে মাছ ধরা), উপকূলের কাছাকাছি ফিশিং ট্রলারের আধিক্য, গলায় ও ফ্লিপারে জাল আটকে যাওয়া, জালে আটকা পড়া কাছিম ছেড়ে না দিয়ে ফ্লিপার কেটে দেওয়া, সৈকতের একদম কাছে কারেন্ট জাল ও ভাসা জাল বিছিয়ে রাখার কারণে কাছিমের জীবন সংহার হচ্ছে। পাশাপাশি যেখানে সেখানে পর্যটন রিসোর্ট ও অপরিকল্পিত গড়ে ওঠা, বিচে অনিয়ন্ত্রিত বাইক চলাচল, অতিরিক্ত আলো ও শব্দদূষণকে কাছিম মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষকরা শনাক্ত করেছেন। এছাড়াও, বিশেষজ্ঞরা বলেন ‘ভুতুড়ে জাল’ একটি বৈশ্বিক সমস্যা; তবে সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর ও দেশের নদীগুলোতে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি হচ্ছে সাগরে পেতে রাখা বৈধ-অবৈধ জালের ছেঁড়া-ফাটা অংশ, যা সমুদ্রে ভেসে মাছ, কচ্ছপ, পাখিসহ সামুদ্রিক নানান প্রজাতি ধ্বংস করছে জেলের তত্ত্বাবধান ছাড়াই। সুনীল অর্থনীতির ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই ছেঁড়া-ফাটা জাল বা ‘ভুতুড়ে জাল’। এটা ভীতিকর ব্যাপার। এটাকে না আটকাতে পারলে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য শিগগির ধ্বংস হবে। কয়েকটি গবেষণার তথ্যমতে, মাছ ধরায় ব্যবহৃত বর্জ্য মোট সামুদ্রিক বর্জ্যরে ১০ শতাংশ, পরিত্যক্ত জাল ৭০ শতাংশ ম্যাক্রোপ্লাস্টিক, যা মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়। ভৌতিক জালে বছরে এক লাখ ৩৬ হাজার সামুদ্রিক পাখি, হাঙ্গর, কচ্ছপ, মাছ এবং অন্য প্রজাতি মারা যায়।

সাগরের এই কাছিমকে বাঁচানোর জন্য সৈকতে কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে সেগুলো প্রাণিজগতের ওপর কী প্রভাব ফেলবে সেটা আগেই ভাবা উচিত। তাছাড়া, জালে আটকা পড়লে কীভাবে কাছিমকে অক্ষত অবস্থায় সাগরে অবমুক্ত করা যায় সেই বিষয়ে মৎস্য শিকারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, Ghost gear ব্যবহার বর্জন করা, ছেঁড়া জাল নদীতে না ফেলা, কাছিম প্রজননের জন্য আলাদা জোন নির্ধারণ করা উচিত। সাধারণত, জালে কাছিম আটকে পড়লে জেলেরা সেটা ছাড়াতে সময় ব্যয় করতে চায় না এবং ট্রলিং করে যারা মাছ ধরে, জাল বাঁচাতে কাছিমের আটকে থাকা অংশ কেটে সাগরে ফেলে দেয়, যা খুবই দুঃখজনক। সামুদ্রিক কাছিমকে জালে আটকা পড়া থেকে রক্ষা করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রলিং নেটে ‘টার্টল এক্সক্লুডার ডিভাইস’ (TED) ব্যবহার নিশ্চিত করছে, যা আমাদের দেশেও করা জরুরি। এক গবেষণায় দেখা গেছে টিইডি ব্যবহারে সামুদ্রিক কাছিমের মৃত্যুর হার ৯৭ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার এখনই সময়। অন্যথায় সবার অজান্তেই সমুদ্রের প্রাণ-প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, একোয়াকালচার বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

mir.ali0077@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION